সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন :

খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে ব্যাংকিং খাতে চার ধরনের সমস্যা আছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা। সেটা হলো ব্যাংকিং খাতের যেসব নীতিমালা আছে, সেগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ক্যামেলস রেটিং অনুসারে ব্যাংকের স্বাস্থ্য পরিমাপের যেসব সূচক, যেমন মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য, খেলাপি ঋণ, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা—এসব ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিপালিত হয় না। যদিও আমাদের আলোচনা কেবল খেলাপি ঋণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা; ২০২৪ সালের জুন মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায়। মূলধনের পর্যাপ্ততা আরেকটি বড় সমস্যা। আন্তর্জাতিক নীতিমালা বা ব্যাসেল অনুযায়ী যে পরিমাণ মূলধন থাকার কথা, তা কিন্তু সবাই মানতে পারে না। বিশেষ করে ১০-১২টি ব্যাংকের এই মূলধন অপর্যাপ্ততা আছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা। আইনে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তা অতটা পরিপালিত হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেই স্বাধীনতা প্রয়োগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। গভর্নর নীতিপরায়ণ হলে তাঁর আয়ত্তের মধ্যে যতটুকু স্বাধীনতা প্রয়োগ করা সম্ভব, তিনি ততটুকু করতে পারেন। কিন্তু সেটা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন টাস্কফোর্স করেছে, তারা এ লক্ষ্যে কাজ করবে বলে আশা করি। এ ছাড়া গত মে মাসে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করাসহ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি দুই ধরনের হয়—এক ধরনের কোম্পানি দুর্বল ব্যাংকগুলোর সম্পদ অধিগ্রহণ করে এবং দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি হলো দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ কিনে পরবর্তীকালে ফেরত দেওয়া হয়। তখন শঙ্কা থেকে যায়, আবারও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সে জন্য এই কাজে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নেওয়া যেতে পারে।

আরেকটি বিষয় আইনগত। অর্থঋণ আদালতে অনেক মামলা পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় বিচারক নেই বলে মামলার কার্যক্রম চলে না। আদালতের বাইরে যে এই সমস্যার সমাধান করা হবে, তার উদ্যোগও নেই।

চতুর্থত, তথ্য প্রকাশ। ব্যাংকগুলো তথ্য প্রকাশ করে না; আগে এ বিষয়ে নজরদারিও করা হতো না। মামলা ও বিশেষ হিসাবে যে অর্থ আটকে আছে, সেগুলো বিবেচনায় নেওয়া হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকা হতে পারে। যথাযথ তথ্য না থাকলে যথাযথ নীতি প্রণয়ন করা যাবে না।

সামগ্রিকভাবে গড়পড়তা তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। যেসব তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক, ব্যাংকগুলো তা দেয় না। সেই সঙ্গে ঋণ শ্রেণিকরণ, পুনঃ তফসিল, অবলোপন—এসব নিয়মকানুন বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে এসব নিয়মকানুন শিথিল করা হয়েছে। এতে কী ফল হয়েছে, তা আমরা জানি না; কিন্তু যা হয়েছে, তা হলো সমস্যার স্তূপ তৈরি হওয়া।

ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান ও র‌্যানকন গ্রুপের গ্রুপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোমো রউফ চৌধুরী গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যাংক খাত সম্পর্কে তাঁর মতামত দেন।

আমি অনেক খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে ব্যাংক খাতকেই আমার মনে হয় সবচেয়ে কম প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটি খাত। কারণ, ব্যাংকের স্প্রেড ৫ শতাংশ। আমাদের ব্যাংকের (ব্যাংক এশিয়া) আমানত ৪০ হাজার কোটি টাকা। আমানত ও ঋণের সুদের ব্যবধান থেকে আমাদের আয় হয় দুই হাজার কোটি টাকা। বাকি আয় ট্রেজারি বিনিয়োগ থেকে আসে। ট্রেজারি বিনিয়োগ থেকে আয় দিয়ে ব্যাংকের প্রকৃত পারফরম্যান্স বিবেচনা করা যায় না। জাপানসহ অনেক দেশে আমানত ও ঋণের সুদহারের মধ্যে ব্যবধান ১ শতাংশ। সেখানে আমাদের দেশে সুদহারের ব্যবধানে এত বেশি কেন? আমি মনে করি, তার প্রধান কারণ খেলাপি বা মন্দ ঋণ। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেশি। আমরা যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়ন করি, তাদের বেশির ভাগই ঋণ ফেরত দিতে নানা সমস্যায় পড়ে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনার কারণে পারফরম্যান্সের বিবেচনায় ব্যাংক থেকে কাউকে চাকরিচ্যুত করা যায় না। আমাদের ব্যাংকে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে মাসে খরচ হয় ৫০ কোটি টাকা। যদি কর্মীদের দক্ষতা বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক চালানো যায়, তাহলে এই খরচ মাসে ৩০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যাংক খাত সম্পর্কে তাঁর মতামত দেন।

খেলাপি ঋণের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। অথচ এটি চোখের আড়ালে থেকে যায়। কারণ, এ ধরনের বাণিজ্যের সব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংগ্রহ করে না। দেশের তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়নে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র (এলসি) বড় অবদান রেখেছে। তবে এটিও ঠিক, আজকের পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যতটা জালিয়াতি হয়, তার ৭০-৮০ শতাংশ হয় ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে। অর্থ পাচারও হয়। সুতরাং, ব্যাক-টু-ব্যাক কখনো নীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ছাড়া গার্মেন্টস চলবে না—আমরা সে অবস্থায় নিয়ে গেছি।

সোর্স প্রথমআলো