বীমা কোম্পানির বোর্ড মেম্বার বা  নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদস্য হিসেবে প্রস্তুতি: গাইডলাইন

বাংলাদেশের বীমা খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক খাত। বীমা খাতের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের জন্য দক্ষ এবং অভিজ্ঞ পেশাজীবী প্রয়োজন। আপনি যদি বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদস্য হিসেবে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে চান, তাহলে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও শেখার ধারা অনুসরণ করা জরুরি। নিচে বীমা খাতে দক্ষতা অর্জনের জন্য কিছু গাইডলাইন দেওয়া হলো:

১. বীমার মৌলিক ধারণা এবং প্রকারভেদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন

প্রথমেই, বীমার মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেওয়া প্রয়োজন। বীমা কিভাবে কাজ করে, বীমার বিভিন্ন ধরণ (যেমন, জীবন বীমা, সাধারণ বীমা, স্বাস্থ্য বীমা, পুনঃবীমা ইত্যাদি) এবং বীমা সংস্থাগুলোর মূল কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে হবে।

শেখার উপায়:

  • বীমা বিষয়ক বই এবং গবেষণাপত্র পড়া।
  • অনলাইনে বীমা বিষয়ক বিভিন্ন কোর্স (যেমন Coursera, Udemy) অনুসরণ করা।
  • বীমা কোম্পানিগুলোর অফিশিয়াল ওয়েবসাইট এবং রিসোর্স সেন্টার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা।

২. বীমা আইন ও নিয়মনীতি বোঝা

বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ (বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ) বীমার আইন, বিধি এবং নীতিমালা পরিচালনা করে। বীমা আইন ২০১০, বীমা করপোরেশন আইন ২০১৯ এবং অন্যান্য নিয়মকানুন সম্পর্কে গভীরভাবে জানুন।

শেখার উপায়:

  • বীমা আইন ২০১০ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইন সম্পর্কে বিস্তারিত পড়াশোনা করা।
  • আইডিআরএ-এর প্রকাশিত রিপোর্ট এবং গাইডলাইন পড়া।
  • প্রয়োজনীয় লিগ্যাল কোর্সে অংশগ্রহণ করে বীমা আইন সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানো।

৩. চর্টার্ড বীমা প্রফেশনাল কোর্স করার পরিকল্পনা করা

বীমা খাতের গভীর এবং পেশাগত জ্ঞান অর্জনের জন্য চর্টার্ড ইনসুরেন্স ইনস্টিটিউট (CII)-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে চর্টার্ড বীমা প্রফেশনাল কোর্স (ACI, FCII) সম্পন্ন করা খুবই কার্যকর। এর মাধ্যমে আপনি বীমা সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ, ক্ষতি নির্ধারণ এবং অন্যান্য জটিল বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন।

শেখার উপায়:

  • CII (Chartered Insurance Institute)-এর কোর্সে নিবন্ধন করা।
  • স্থানীয়ভাবে ICAB (Institute of Chartered Accountants of Bangladesh) এবং ICMAB (Institute of Cost and Management Accountants of Bangladesh)-এর সাথে যোগাযোগ রাখা।

৪. আন্তর্জাতিক বীমা নিয়মনীতি ও মান সম্পর্কে জ্ঞান

বীমা একটি গ্লোবাল খাত। তাই, আন্তর্জাতিক বীমা নিয়মনীতি এবং মান (যেমন, Solvency II, IFRS 17) সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। এতে আপনি বিশ্বব্যাপী বীমা শিল্পের প্রবণতা এবং বাংলাদেশের সাথে তুলনামূলক বিচার করতে সক্ষম হবেন।

শেখার উপায়:

  • আন্তর্জাতিক বীমা রিপোর্ট এবং গবেষণা পড়া।
  • ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইনসুরেন্স সুপারভাইজর্স (IAIS)-এর সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করা এবং তাদের প্রকাশিত দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা।

৫. বীমার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং পুনঃবীমা বোঝা

ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বীমা খাতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুনঃবীমা এবং ঝুঁকি ট্রান্সফার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে হবে, কারণ এগুলো বীমা কোম্পানির আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং ক্ষতির ন্যায্য সমাধান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শেখার উপায়:

  • ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং পুনঃবীমা সংক্রান্ত কোর্স করা।
  • বীমা কোম্পানির রিস্ক ম্যানেজমেন্ট রিপোর্ট পড়া।

৬. বীমা সংস্থার কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক কাঠামো বোঝা

বীমা সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা নেওয়া অপরিহার্য। এর মাধ্যমে বীমা সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং কার্যপ্রণালী সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।

শেখার উপায়:

  • বীমা কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা।
  • বীমা খাতের বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তর এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

৭. বীমার প্রযুক্তিগত দিক

আধুনিক বীমা খাতের অনেক অংশ প্রযুক্তি-নির্ভর। ই-কমার্স, ডিজিটাল বীমা (InsurTech), এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স বীমার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে। তাই, এসব বিষয় সম্পর্কে দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন।

শেখার উপায়:

  • InsurTech বিষয়ক বিভিন্ন ওয়ার্কশপ এবং প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করা।
  • ডিজিটাল বীমা প্রযুক্তি সম্পর্কে পড়াশোনা করা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

৮. ক্ষতি নির্ধারণ ও সমাধান প্রক্রিয়া বোঝা

বীমা দাবির ক্ষেত্রে ক্ষতির মূল্যায়ন এবং দ্রুত নিষ্পত্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য বীমার ক্ষতি নির্ধারণ পদ্ধতি এবং এর সমাধান প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে।

শেখার উপায়:

  • বীমা দাবির মূল্যায়ন এবং ক্ষতির সমাধান প্রক্রিয়ার উপর কোর্স করা।
  • বীমা ক্ষতি নির্ধারণকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেওয়া।

৯. মার্কেট ট্রেন্ড এবং গবেষণা বিশ্লেষণ

বীমা খাতের উন্নয়নে বাজারের প্রবণতা, চাহিদা, এবং প্রতিযোগিতা সম্পর্কে জানতে হবে। গবেষণা ও ডেটা বিশ্লেষণ করে নীতিনির্ধারণে সহায়তা করা প্রয়োজন।

শেখার উপায়:

  • বীমা খাতের বর্তমান বাজার প্রবণতা এবং ডেটা বিশ্লেষণ রিপোর্ট পড়া।
  • বীমা সংস্থাগুলোর গবেষণা এবং উন্নয়ন বিভাগে কাজ করা।

১০. আইডিআরএ এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রম বোঝা

আইডিআরএ-র দায়িত্ব এবং কার্যক্রম সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে হবে। এর সাথে আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ।

শেখার উপায়:

  • আইডিআরএ-র নীতিমালা, প্রকাশনা এবং দিকনির্দেশনা সম্পর্কে পড়া।
  • আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ও বিধিনিষেধ বিশ্লেষণ করা।

উপসংহার:

বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদস্য হিসেবে দক্ষতা অর্জন করতে হলে পেশাগত যোগ্যতা, আইনি জ্ঞান, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকা অপরিহার্য। এই ধাপগুলো অনুসরণ করে আপনি নিজেকে একজন দক্ষ বীমা বিশেষজ্ঞ এবং সফল নিয়ন্ত্রক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।